চারজন জ্ঞানী ব্যক্তি এসেছেন হযরত বায়েজীদ রহমাতুল্লাহ-এর দরবারে। সূক্ষ্ম মারেফত তত্ত্বের আলােচনা হবে। একটি ঝকঝকে সাদা পেয়ালায় কিছু মধু ও একগাছি চুল এনে আলােচনা সভায় রাখা হল। জ্ঞানী ব্যক্তিরা এর উদ্দেশ্য অনুমান করে এ বিষয়ে নিজ নিজ মত ও মন্তব্য প্রকাশ করলেন।
প্রথম জন। মানুষের জ্ঞান ও বুদ্ধি এই পেয়ালা থেকেও অধিক স্বচ্ছ। বিদ্যা এ মধু থেকেও উপাদেয় । আর মমতা এ চুল থেকেও সূক্ষ্ম। | দ্বিতীয় জন। স্বর্গের পেয়ালা এ পেয়ালা থেকেও উত্তম। জান্নাতের মধুর স্বাদ এ মধুর চেয়েও উদ্ধৃষ্ট। আর পুলসিরাত এ চুল থেকেও সরু। | তৃতীয় জন । মুমিনের অন্তর এ পেয়ালা থেকেও উজ্জ্বল ও স্বচ্ছ। এ মধুর মিষ্টতার চেয়ে আল্লাহর কালামের মাধুর্য আরও উন্নত। আর হক হকুকের জ্ঞান এ চুল থেকেও সূক্ষ্মতম। _ চতুর্থ জন ॥ ইখলাসের পরিপাট্য এ পেয়ালা অপেক্ষা বেশী। এবাদত-ধ্যান এ মধুর চেয়েও মধুরতর। আর পবিত্রতা ও ধর্মনিষ্ঠা এ চুলের চেয়েও সূক্ষ্মতর।
সব শেষে মুখ খুললেন হযরত বায়েজীদ রহমাতুল্লাহ। বললেন, মারেফত বিদ্যা এ পেয়ালা থেকে বেশী সাদা, বেশী স্বচ্ছ। আল্লাহর প্রেমের স্বাদ এ মধুর চেয়েও মধুরতর। আর আল্লাহর ভয় চুল অপেক্ষাও সরু, তীক্ষ।
বায়েজীদ রহমাতুল্লাহ-এর উপদেশ বাণীঃ আৱেফ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন
১. আরেফের বা কামেল লোকের চরিত্রে আল্লাহর গুণাবলী থাকবে।
২. ধ্যান ও এবাদত-বন্দেগীর তরবারি দিয়ে যিনি যাবতীয় কামনা-বাসনা কেটে ফেলেছেন, তিনিই খাটি আরেফ বা কামেল।
৩, আরেফের বা কামেল লোকের কাছে মারেফতের তুচ্ছ একটি বিন্দু জান্নাতের লক্ষ লক্ষ বালাখানা থেকেও মুল্যবান। |
৪, আরেফ যখন নীরব, তখন তার ইচ্ছা হয় আল্লাহর সঙ্গে কথা বলতে। আর যখন তিনি মুদিত আঁখি, তখন তার ইচ্ছা হয় তার সঙ্গে দেখা করতে। যখন দু'হাঁটুর মাঝখানে মাথা রেখে তিনি চোখ বুজে থাকেন, তখন তিনি ভাবতে থাকেন, এখন ইস্রাফীল যদি শিঙায় ফুঁ দিতেন, তাহলে মাথা তুললে, মাবুদের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত হয়ে যেত। |
৫, আল্লাহ যেমন একা, সঙ্গীবিহীন। একা থাকেন আর একা থাকতে ভালােও বাসেন, তেমনি আরেফ বা কামেল লোকও মানুষের ভিড় পছন্দ করেন না। একা থাকতে ভালােবাসেন।
৬, আরেফকে বা কামেল লোককে কেউ প্রভাবিত করতে পারে না। কিন্তু সবই তার দ্বারা প্রভাবিত হয়।
৭, আরেফ বা কামেল লোক নিজেকে নির্বোধ মনে করেন। কিন্তু নির্বোধেরা নিজেদের আৱেফ বা বিজ্ঞ মনে করে।
৮, আরেফ বা কামেল লোক হল উড়ন্ত পাখী। আর যারা আরেফ নয়, তারা হল চতুষ্পদ প্রাণী।
৯, আরেফের বা কামেল লোকের অন্তর হল স্বচ্ছ কাচে ঘেরা বাতির মতাে। তার অত্যুজ্জ্বল আলােয় আলােকিত হয় আলমে আরওয়াহ।
১০, আরেফ বা কামেল লোক পানাহার করেন নিজের সঙ্গে, কেনাকাটা করেন নিজ থেকে। বিক্রি করেন নিজের নিকট। আবার নিজ থেকে তিনি দূরে সুদূরেও থাকেন। নিদ্রায় কিংবা জাগরণে তিনি আল্লাহ ছাড়া আর কিছুই দেখেন না। আল্লাহ ছাড়া কারাে সঙ্গে তিনি মিলিতও হন না। আর নিজের মনের কথা আল্লাহ ছাড়া আর কারাে কাছে প্রকাশও করেন না।
১১. আরেফের বা কামেল লোকের জন্য যা অবশ্য পালনীয়, তা হল বিষয়-বিভব থেকে নিস্পৃহ থাকা। জান্নাতের ভরসা না করা ও জাহান্নামের পরােয়া না করা।
আল্লাহর আনুগত্য প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন* ১. আল্লাহর আনুগত্য অক্ষুন্ন রাখতে হলে মৃত্যুর পূর্বে মৃত্যুবরণ কর।
২. ক্ষুধার্ত থাকায় লাভ কি? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ক্ষুধার্ত থাকলে ফেরাউন ‘আমি তােমাদের আল্লাহ’-এই কথা বলার সুযােগ পেত না।
একজন বলল, আল্লাহর আনুগত্যের ব্যাপারে মনে হয় অলৌকিক ক্ষমতাও অন্তরায়। যেমন- আপনি পানির ওপর হাঁটতে পারেন, শূন্যে উড়তে পারেন, এক রাতে মক্কায় পৌছাতে পারেন। এগুলাে কি মনের মধ্যে অহঙ্কার সৃষ্টি করে না? তিনি বললেন, এ তােমার ভুল ধারণা। এক টুকরা কাঠও পানিতে ভাসতে পারে। ক্ষুদ্র বালুকণাও বাতাসে উড়তে পারে। জাদুকরও এক রাতের মধ্যে হিন্দুস্তান থেকে বেলুচিস্তানে যেতে পারে। অতএব, অলৌকিক শক্তি কী এমন বস্তু যে, তার দ্বারা অহমিকা সৃষ্টি হবে।
৩, আল্লাহর অনুগত লােকের কর্তব্য কি? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আল্লাহ ছাড়া অন্য দিকে মন না দেওয়া। | ৪, আল্লাহকে পাওয়ার পথ কি? তার উত্তর, অহম্ বা আমিত্ব বর্জন করা। ৫. তিনি বলেন, দুটি জিনিস ধ্বংস ডেকে আনবে। যথা(১) আল্লাহর সৃষ্টিকে সম্মান না করা ও (২) আল্লাহর অবদান স্বীকার না করা। ৬, আল্লাহ আপন ইচ্ছায় কি তার দাসদের জান্নাতবাসী করেন না?
তার উত্তর, হ্যা, তা করেন বৈকি! তবে কথা হল, আল্লাহ্ যাকে উচ্চস্তরে নিয়ে। গেছেন, তার আর জান্নাতের দরকার কি?
৭, আল্লাহকে যারা পেয়েছেন, তাঁরা জান্নাতের শােভা বর্ধন করেন ঠিকই। কিন্তু জান্নাত তাদের জন্য এক আযাব ছাড়া অন্য কিছু নয়।
৮, আল্লাহ তাঁর প্রিয়জনদের তিনটি স্বভাব দান করেন। যেমন(১) সমুদ্রতুল্য বদান্যতা, (২) সূর্যসম উদারতা ও (৩) ভূততুল্য নম্রতা।
৯, আল্লাহ যাকে যােগ্য ও উপযুক্ত মনে করেন, তার পেছনে এক ফেরাউন লাগিয়ে দেন।
১০, সৎ-সংসর্গ সৎ-কার্য থেকে উত্তম। আর কু-সংসর্গ -কুকার্য থেকে নিকৃষ্ট।
১১, গৌরব ও মর্যাদার লােভে যে বিদ্যালাভ করে তার থেকে দূরে থাক। কেননা, প্রতি মুহূর্তে আল্লাহর রহমত তার পেছনে দূরে সরে যায়।
১২. মুসলমান হয়ে মুসলমানের ক্ষতি করা কঠিন পাপ কাজে লিপ্ত হওয়ার চেয়েও মারাত্মক।
১৩, মানুষের মনােভাব এরূপ হতে হবে যে, আমার মতাে খারাপ অরি কেউ নেই।
আমার কোন মূল্যই নেই। এ ধরনের মনােভাব ত্যাগ-তিতিক্ষা, জ্ঞানার্জন ও পুণ্যচর্চা
থেকেও উত্তম।
১৪, জ্ঞান অর্জন করতে হবে জ্ঞানী ব্যক্তির কাছ থেকে। |
১৫, মানুষ যদি নিজেকে নিজে চিনতে পারত তাহলে কত যে ভালাে হত!
নিজেকে নিজে চিনতে পারলে পূর্ণ মারেফত অর্জিত হয়।
১৬, দুনিয়ার এমন কী মহিমা আছে যে, মানুষ তাকে ভুলতে পারে না?
আল্লাহর প্রেমিক যারা, দুনিয়াকে ভুলে যাওয়া তাদের পক্ষে মােটেই কঠিন নয়।
১৭, যারা আল্লাহকে চেনে না, আগুন তাদের শাস্তি দেয়। কিন্তু যারা চেনে,
আগুনের পক্ষে তারা অসহ্য।
১৮, যে আল্লাহকে চিনেছে, কারাে কাছে তার কিছু চাইবার নেই।
কিন্তু যে আল্লাহকে চেনেনি, সে অপরের মুখাপেক্ষী এবং মর্যাদাহীন।
১৯. পূর্ণ মাত্রায় প্রয়াস ও প্রযত্ন করে আল্লাহর রহমতের ওপর ভরসা রাখতে হবে।
২০, পার্থিব সম্পদের প্রতি (লােভ করলেও) আকৃষ্ট হতে নেই। দুঃখ-দুর্দশায় হতাশ হতে নেই।
কেননা, আল্লাহর সামান্যতম নির্দেশে তা দূর হতে পারে।
২১, রিপুর বাসনা যে ত্যাগ করেছে, সে আল্লাহকে পেয়েছে।
আর যে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করেছে, সব কিছু তার নাগালে এসে গেছে। |
২২, নিজেকে যে উত্তম মনে করে, নিজের এবাদতকে ক্রটি-হীন ভাবে,
নিজের অন্তরকে বিশুদ্ধ বলে মনে করে, সে হিসাবের মধ্যেই গণ্য নয়।
আর পার্থিব আশাকিাকা দ্বারা যে অন্তরে মত, মৃত্যুর পর তাকে লা'নতের কাফন
পরিয়ে অপদস্থতায় মৃত্তিকাতলে দাফন করা উচিত। আর যে রিপুর
কামনা-বাসনা অবদমিত করেছে, মৃত্যুর পর তাকে প্রশংসার কাফনে আবৃত করে
শান্তির ভূমি-তলে দাফন করা চাই।
২৩. যে শিষ্য চীৎকার করে, হা-হুতাশ করে, সে একটি ক্ষুদ্র কুপ সদৃশ।
আর যে মৌনতাবলম্বন করে সে রত্ন-গর্ভ সমুদ্রের ন্যায় ।
২৪, দুনিয়ার আলােড়ন ও নীরবতা সবই আল্লাহর কাছ থেকে এ কথা অন্তরে
উপলব্ধি করার নামই হল মারেফত।
২৫. আগামীকালের কথা না ভেবে বর্তমাননিষ্ঠ হওয়াকেই বলে নির্ভরতা।
২৬. যে ধ্যান একাগ্র নয়, তা খুব বেশী হলেও ধ্যান নয়।
২৭, পরােপকারী ও সমব্যথী ব্যক্তি পৃথিবীর যে কোন মানুষের
চেয়ে আল্লাহর অধিকতর নিকটবর্তী।
২৮, আল্লাহকে স্মরণ করার নামই হল নফসকে ভুলে যাওয়া। যে ব্যক্তি আল্লাহকে
নিজের মতাে করে চেনে, সে মৃত, আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে আল্লাহর মতাে করে চেনে,
সে জীবিত।
২৯, আল্লাহর সঙ্গে সহাবস্থান করা ফরজ আর দুনিয়ার কাজ করা সুন্নত।
৩০, কেউ কিছু দান করলে প্রথমতঃ আল্লাহর শােকর আদায় কর। পরে দাতার প্রতি
কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।
৩১. কোন অসৎ ব্যক্তি তােমার কাছে এলে তুমি তার প্রতি অসদাচরণ না করে
উত্তম আচরণ কর। তাতে তার স্বভাবের পরিবর্তন হবে।
৩২, জান, এ কার সৃষ্টি। তিনি যেখানেই থাকুন না কেন, তাকে ভয় করে চল।
যেহেতু তিনি তােমার সব কিছুই জানেন।
৩৩, যিনি পীড়িতের সেবা করেন, মানুষের দোষ-ত্রুটি মাফ করেন,
আর সত্য ঘটনা গােপন করেন না এমন লােকের সংসর্গ অবলম্ন কর। |
৩৪, আল্লাহর প্রতিটি কাজ পছন্দনীয় ও সন্তোষজনক। তিনি যদি কোন মানুষকে।
অবনতি ও দুর্গতির চরম সীমায় পৌছে দেন, তবুও তা পরম পুলকে বরণ করা চাই।
৩৫, আল্লাহকে কিভাবে পাওয়া যায়? তার উত্তর, অন্ধ, বধির ও মূক হয়ে যাও।
৩৬. দুনিয়াদারের জন্য দুনিয়া এক গৌরবের স্থান।
পূন্যবানদের জন্য পরকাল এক আনন্দের স্থান।
আর আল্লাহর সঙ্গে বন্ধুত্ব স্তাপন করা সাধকগণের জন্য এক নূর ছাড়া। আর কিছু নয়।
৩৭, হজ্জযাত্রীরা স্বশরীরে মক্কায় গিয়ে কাবাঘর তওয়াফ করতে আর সেখানে থাকতে চান।
আর আল্লাহর প্রেমিকগন আত্মিক ভ্রমণে আল্লাহর সাক্ষাত করতে চান।
৩৮, আল্লাহর দীদার লাভের আগে যত কিছু বাকবিতন্ডা,
আর দীদার ঘটে গেলে যাবতীয় তর্ক-বিতর্কের অবসান ঘটে।
৩৯, এমন এক বিদ্যা রয়েছে যা আলেমগণের জ্ঞানের বাইরে। আর এমন এক ত্যাগ রয়েছে,
যা বৈরাগীদের জ্ঞানের বাইরে।
৪০, যে নিজেকে নিজে আরেফ বলে, সে মূর্খ।
আর যে নিজেকে মূর্খ বলে ঘােষণা করে, সে আরেফ বটে।
৪১, যে মানুষের সম্মান রক্ষা করে, সে আল্লাহর নিকটবর্তী।
আর যে মানুষের সম্মান নষ্ট করে, সে আল্লাহর দূরবর্তী।
৪২. জ্ঞান মানুষের জীবনী-শক্তি। মারেফত তার হৃদয়ের শান্তি । আর এবাদত এক আস্বাদপূর্ণ বস্তু।
৪৩, নিজের যােগ্যতা অনুযায়ী নিজের প্রচার করা উচিত।
অথবা যেমন প্রচার করে তেমনি হয়ে যাওয়া।
৪৪, মানুষের কুপ্রবৃত্তি প্রবল হলে অন্তর দুর্বল হয়। আর অন্তর সবল হলে কুপ্রবৃত্তি দুর্বল হয়।
| ৪৫, আল্লাহ তাআলার একত্ব ছাড়া অন্য বিষয়ে আলেমগণের মধ্যে যে মতভেদ দেখা। যায়,
তা আল্লাহরই বৈকি।
৪৬, আপনি রাতে নফল নামাজ পড়েন না কেন?
তার উত্তর, আমি প্রতি রাতে আত্মিক জগতে ভ্রমণ করি। |
৪৭, তবলীগ করার গুরুত্ব কী?
তার উত্তর, সেটি উত্তম কাজ। তবে তুমি এমন জায়গায় বসবাস কর, যেখানে তার। দরকার নেই।
৪৮, যে ব্যক্তি আল্লাহকে চিনেছে সে কথা বন্ধ করেছে।
৪৯. আল্লাহর দীদারের অবস্থা কিরূপ?
তার উত্তর, মানুষকে পানিতে ডুবতে দেখেছ কি? সাগরে ডুবে সে মারা
গেলে আর এ জগতে ফিরে আসে না।
তেমনি কেউ যদি আল্লাহর দীদার লাভ করে, তাহলে তাতেই ডুবে থাকে চিরদিন।
৫০, দরবেশ কে?
তাঁর উত্তর, যে ব্যক্তি অন্তরের অন্তস্থলে প্রবেশ করে একটি গুপ্ত কক্ষের সন্ধান পায়,
মােতির সিন্দুক লাভ করে, সেই দরবেশ।
৫১. মানুষের উত্তম কাজ কি? তার উত্তর, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া
অন্য কোন দিকে ধাবিত না হওয়া।
৫২. আপনার আয়ু কত? তার উত্তর, মাত্র চার বৎসর।
সবাই বিস্ময় প্রকাশ করলে তিনি তাঁর কথার ব্যাখ্যা দেন যে,
সত্তর বছর পর্যন্ত তিনি পার্থিব ঝামেলায় জড়িত ছিলেন। মাত্র গত
চার বছর ধরে তিনি তাঁর মাবুদকে দেখছেন।
অতএব ঐ চার বছর ছাড়া বাকী জীবনকে তিনি আয়ুর মধ্যে গণ্য করেন না।
৫৩, যদি তুমি মন্দ স্বভাবে অভ্যস্ত হও, তাহলে তা পরিবর্তন করে সৎ স্বভাৰে অভ্যাস করার চেষ্টা কর।
৫৪. মানুষ কখন সাফল্য অর্জন করে?
তাঁর উত্তর, যখন মানুষ সৃষ্টিজগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নির্জনে নিজের দোষ ত্রুটি
সম্বন্ধে চিন্তা-ভাবনা করে। এর দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়।
৫৫. হযরত আহমদ খাজুরাই রহমাতুল্লাহ-এর আক্ষেপ, প্রাণপণ ধ্যান-এবাদত ইত্যাদি
করেও উচ্চ মর্যাদার
অধিকারী হওয়া গেল না। তিনি বলেন, আপনি তাে মর্যাদার চরম শিখরে আরােহণ
করার ইচ্ছা পােষণ করেন।
অথচ তা হল আল্লাহর নিজস্ব ব্যাপার। সেটি লাভ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
৫৬, নামাজের খাটি ও আসল পরিচয় কি? তার উত্তর, যার দ্বারা আল্লাহর দীদার লাভ হয়।
তবে তা হওয়া খুবই কঠিন।
৫৭, আরশের প্রকৃত অর্থ কী? তাঁর উত্তর, আরশ তাে আমি নিজেই।
প্রশ্নঃ কুরসী কী? তার উত্তর, কুরসীও আমি নিজেই।
প্রশ্নঃ কলম কী? তাঁর উত্তর, কলমও আমি নিজেই।
এরপর তাঁকে হযরত ইব্রাহীম (আঃ), হযরত মূস (আঃ) ও হযরত ঈসা (আঃ) সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়।
আর প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি ঐ একই উত্তর দেন।
জবাব শুনে প্রশ্নকর্তা নির্বাক হয়ে গেলে হযরত বায়েজীদ রহমাতুল্লাহ বললেন,
আমি নিজেকে আমার প্রভুর মধ্যে বিলীন করে দিয়ে দেখতে পেলাম,
সৃষ্টির সকল বস্তু আমার অস্তিত্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ।
তাঁর আধ্যাত্মিক ?
১. আমি পৃথিবীকে তিন তালাক দিয়ে সম্পূর্ণ একা হয়ে বলতে শুরু করলাম,
হে আমার প্রতিপালক! আপনি ছাড়া আমার আর কেউ নেই।
তবে আপনি যখন আমার, তখন সব কিছুই আমার।
২. আমি যখন আল্লাহর দরবারে সম্পূর্ণ খাটি বলে বিবেচিত হলাম,
তখন তিনি আমাকে প্রথমে এই নেয়ামত দান করলেন যে,
আমার মধ্যে যা কিছু কালিমা ও কলুষতা ছিল তা ধুয়ে-মুছে সাফ করে দিলেন।
৩. আর আল্লাহ পাকের এই অফুরন্ত করুণার ফলে আমার মানসিকতা ও অনুভূতির পরিবর্তন ঘটল।
৪, অনুভব করলাম, যারা আল্লাহর আদেশ পালন করেছে,
তারা তার পুরস্কার লাভ করেছে ও পুরস্কারের প্রতি আসক্ত হয়েছে।
কিন্তু আমি আল্লাহ ছাড়া কোন কিছুতেই আসক্ত হইনি।
৫, আমার মনে আল্লাহর সঙ্গে প্রেম করার ইচ্ছার উদয় হল।
কিন্তু পরে চিন্তা-ভাবনা করে দেখলাম, আমার প্রতি তার প্রেম তাে অনেক
আগে থেকেই রয়েছে।
৬, দেখলাম, সবাই নিজ নিজ কাজে মশগুল।
কিন্তু আমি শুধু আল্লাহ পাকের করুণা সাগরে সাঁতার কাটছি।
৭, মানুষ মরণশীল মানুষের কাছ থেকে জ্ঞান লাভ করেছে। কিন্তু আমি জানি,
লাভ করেছি স্বয়ং আল্লাহর কাছ থেকে, যিনি চিরঞ্জীব, যার কখনও মৃত্যু নেই।
৮, সৰ মানুষ আল্লাহর কালাম নিজে উচ্চারণ করে।
কিন্তু আমি উচ্চারণ করি আল্পহার তরফ থেকে।
৯, আমি যখন আমার প্রবৃত্তিকে আল্লাহর দিকে নিতে চাইলাম,
আর সে তা প্রত্যাখ্যান করল, তখন আমি একাই আল্লাহর দরবারে হাজির হলাম।
১০, আমি ভেবে দেখেছিলাম, আমার শাস্তি পাওয়ার মূলে কোন বস্তু?
তা আলস্য বা শৈথিল্য ছাড়া আর কিছু নয়।
বােঝা গেল, সামান্য গাফিলতির চেয়ে জাহান্নামের আগুনও তেমন কিছু ভয়াবহ নয়।
হযরত বায়েজীদ রহমাতুল্লাহ-এর দীদারে ইলাহীর স্বরূপ। হযরত বায়েজীদ রহমাতুল্লাহ
একদিন আল্লাহ পাককে স্বপ্নে দেখলেন। আল্লাহু জিজ্ঞেস করলেন,
তােমার মনের ইচ্ছা কি? তুমি কি চাও?
বায়েজীদ রহমাতুল্লাহ বললেন, প্রভু আমার! আপনার ও আমার ইস্যর
মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। তখন প্রভু বললেন, তাহলে আমি যেমন তােমার,
তেমনি তুমিও আমার হও। বায়েজীদ রহমাতুল্লাহ বললেন, আপনার দিকের পথ আমাকে
দেখিয়ে দিন। আল্লাহ বললেন, আমিত্ব বর্জন কর। পথ মিলে যাবে। তিনি প্রভুর নির্দেশ মেনে নিলেন।
অতঃপর তিনি একাগ্র চিত্তে তার দিকে চোখ মেলে চাইলেন।
আল্লাহ তাঁকে পরনির্ভরশীলতা থেকে মুক্ত করলেন। আলােকিত করলেন তাঁর জ্যোতি দিয়ে।
বহু গুড় কথা তার কাছে ব্যক্ত করলেন। তার গরিমা ও শান-শওকত দেখালেন।
তখন বায়েজীদ রহমাতুল্লাহ তার নিজের দিকে দৃষ্টি দিয়ে দেখলেন,
আল্লাহ পাকের গরিমাময় ঐশ্বৰ্য্য আর আভিজাত্যের তুলনায় তার নিজের গৌরব
অতি নগণ্য ও নিষ্প্রভ। সে তুলনায় তাঁর জ্যোতিও অনুকল। | বায়েজীদ রহমাতুল্লাহ-এর সম্মান মর্যাদা তার প্রতিপালকের সম্মান-মর্যাদার কাছে নিতান্ত হেয় প্রতিপন্ন হল। িআরও গভীর দৃষ্টি দিয়ে দেখতে পেলেন যে, তার নিজের নূর তারই দূর থেকে সম্মানও তারই সমান থেকে। তিনিই তাে সব কিছুর উৎস। তিনি নিবেদন করলেন, বড় গাে! এ কী ব্যাপার? প্রভু বললেন, হ্যা তাই। সব কিছুই আমি এবং সব কিছুই আমার। আমি ও আমার ছাড়া কোন কিছু নয় ও কোন কিছুই নেই। শুধু কাজটি তােমার দ্বারা প্রকাশ পায় মাত্র। আর তা করার শক্তি, সাধ্য ও সফলতা আমার দ্বারাই ঘটে।
অতঃপর তার প্রভু তার অর্ন্তদৃষ্টি ও বহিদৃষ্টি ঢেকে দিলেন।
আর এ অবস্থায় তিনি তাঁর তৌহীদের রূপ প্রদর্শন করলেন
তখন হযরত বায়েজীদ রহমাতুল্লাহ আমিত্ব বিসর্জন দিয়ে হৃদয়কে সঞ্জীবিত করলেন।
এবার প্রভু খুব দয়া করে তার গুপ্ত তবে তাকে প্রকাশ্য আন দান করলেন।
আর এই জ্ঞানের দ্বারা তিনি তাঁকে অনুভব করলেন অর্থাৎ তঁার দীর লাভে ধন্য হলেন। |
এবার তার পার্থিব কামনা-বাসনা নির্মূল হল। আর এভাবে সব কিছু পরিহার
ও পরাভূত করে তিনি কিছু দিন একা একা কাটিয়ে দিলেন।
অতঃপর দয়াময় প্রভু ওঁর প্রতি আরও দয়াপরবশ হলেন। তিনি তাঁর ক্ষুর দিয়ে হযরত
বায়েজীদ রহমাতুল্লাহ-এর চোখ দৃষ্টি করলেন।
আর তা দিয়ে তিনি সমগ্র সৃষ্টিকে, প্রত্যক্ষ করলেন। | তারপর তারই প্রদত্ত জ্ঞান বলে
তিনি তাঁরই কাছে নিবেদন করলেন, প্রভু গো। আমি আপনাকে ছাড়া অবস্থান করব
তা আমার কাম্য নয়, আমি আপন অস্তিত্বে সন্তুষ্ট নই। প্রভু! আমাকে আপনি আমি
ছাড়া করে রাখুন। | প্রভু বললেন, তা উত্তম। কিন্তু শরীয়তের সীমা রক্ষা করে চল।
আদেশ নির্দেশের সীমা লঙ্ঘন করাে না। তবেই তােমার সাধনা সফল হবে।
তারা দাস বললেন প্রভু আমি তাে নিজে কিছুই জানি না, বুঝি না। একেবারেই অজ্ঞ,
আপনিই আমাকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করুন।
প্রভু প্রশ্ন করলেন, এ কথা তুমি কোথায় শিখলে? দাস উত্তর দিলেন,
প্রশ্ন কর্তাই তা বেশী জানেন। কেননা, এ প্রশ্ন ও জবার্তারই।
ক্রমে ক্রমে মনে হল, প্রভু তাঁর ওপর খুশী হয়েছেন। তিনি দাসের মনে আনন্দের ঢেউ তুলে দিলেন।
তারপর বললেন, তােমার মনে যে বাসনা রয়েছে তা প্রকাশ কর।
তার উত্তর, প্রভু গাে! আমার বাসনা তাে শুধুই আপনি। আমি কেবল আপনাকে চাই।
আর কিছুই আমার কাম্য নয়। | কিছুক্ষণ নীরব থেকে প্রভু বললেন, হ্যা, তুমি ঠিকই বলেছ।
তুমি আল্লাহরই প্রত্যাশী। আর এ জন্যেই দেখতে ও শুনতে পেলে।
দাস বললেন, তা আমার ক্ষমতায় নয়। বরং তা প্রভুর ইচ্ছায় ঘটেছে।
তারপর তিনি তার মহান প্রতিপালকের প্রশংসা করলেন।
এবার প্রভু তাঁকে তাঁর গৌরবের পাখা দান করলেন। মাথায় পরিয়ে দিলেন গৌরবের তাজ।
আর গৌরবের পাখায় ভর করে তিনি গৌরবের আকাশে উড়তে লাগলেন।
প্রভুরই, সাহায্যে তার অপূর্ব গুণাবলী অবলােকন করলেন। তিনি এবার তার
একত্বের দুয়ার খুলে দিলেন। আর তাঁর দপ্তরে দাসের নামও নথি-বন্ধ করলেন।
এবার তার কাছে প্রভুর তৌহীদ আবিষ্কৃত হল। | অতঃপর তার প্রতিপালক বললেন,
এখন আর কেউ তােমার ভেতরে আমিত্বের লক্ষণ দেখবে না। তারপর এক পরীক্ষায়
আগুনে পুড়িয়ে পবিত্র করে তিনি তার দাসকে জিজ্ঞেস করলেন, বল, এ দুনিয়া কার?
বল এ রাজত্ব কার?
দাস বললেন, আপনার। বল, ক্ষমতা করি। সবই আপনার।
অতঃপর দাসকে পরিয়ে দেওয়া হল ধৈর্যের পােশাক ।
এর ফলে দাস মানবীয় স্বভাব। মুক্ত হলেন আর অর্জন করলেন তৌহীদের জবান।
মনে হল, তার আল্লাহর রহমতের প্রশংসাতে, তার চোখ আল্লাহর অনুপত সৌন্দর্যরাশিতে,
এবং তার হৃদয় আল্লাহর অনির্বচনীয় আলােকমালায় রূপান্তরিত হল।
এখন তার দৃষ্টি সসীম নয়, অসীমের পানে। প্রসারিত । তিনি এখন চিরঞ্জীব।
তার আর মৃত্যুর আশঙ্কা নেই। এখন তিনি নিজে চলেন। নী। নিজে এবাদত করেন না।
সব কিছু অনুষ্ঠিত হচ্ছে মহিমাময় প্রভুর ইশারা-ইঙ্গিতে। তিনি কেবল উপলক্ষ মাত্র।
অতঃপর তিনি তার প্রতিপালককে বললেন,
হে প্রভু। আমি তাে এখন আপনার দরবারেরই অধিবাসী।
প্রতিপালক বললেন, কিন্তু মানুষ যে তােমাকে দেখতে চায়।
বায়েজীদ রহমাতুল্লাহ বললেন, কিন্তু আমি তাে তাদের দেখতে চাই না।
তবে আপনি যদি আমাকে মানুষের মাঝখানে রেখে দিতে চান,
আমার আপত্তি নেই। কেননা, আপনার
0 Comments